সীমাহীন আর্থিক সংকট, অনিশ্চিত ভবিষ্যৎ আর জীবনযুদ্ধে প্রতিনিয়ত সংগ্রাম ছিল মো. সালমান খন্দকার রিয়াদের। কিন্তু হার মানেনি। ভ্যানচালক বাবার ঘামে ভেজা আয়ে কোনোমতে চলত অভাবের সংসার। যেখানে বই-খাতা-কলম কিনতেই কষ্ট হতো, সেই বাবার ছেলে এবার জয়ী হয়েছেন দেশের শীর্ষস্থানীয় পাঁচ পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তিযুদ্ধে।
শেরপুরের শ্রীবরদী উপজেলার কাকিলাকুড়া ইউনিয়নের পিরিজপুর গ্রামের মো. বাবুল খন্দকারের সন্তান সালমান। মা ছালেমা বেগম গৃহিণী। চার ভাই-বোনের মধ্যে তৃতীয় সালমান ছোটবেলা থেকেই স্বপ্ন দেখতেন উচ্চশিক্ষা অর্জন করবেন। কিন্তু তার স্বপ্নপূরণের পথে ছিল হাজারো বাধা।
সালমান কাকিলাকুড়া মাদ্রাসায় প্রথম শ্রেণি থেকে দাখিল শেষ করেন এবং কাকিলাকুড়া ফাজিল ডিগ্রি মাদ্রাসায় থেকেই আলিম পাস করে অংশ নেন দেশের নামকরা বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর ভর্তি পরীক্ষায়। আর সেখানেই সৃষ্টি করেন এক অনন্য ইতিহাস।
সালমান ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে মেধাক্রম ৬২৭, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে ২৬৪, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ‘ডি’ ইউনিটে ২০৩ ও ‘বি’ ইউনিটে ২৬৬, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ে ১২৩ এবং বিইউপিতে ১৩৮তম অবস্থান অর্জন করেন এই মেধাবী ছাত্র। তার স্বপ্ন এখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা করে এক দিন দেশের জন্য কিছু করার।
সালমানের এই সাফল্যের পেছনে যেমন ছিল বাবার হাড়ভাঙা পরিশ্রম, তেমনি ছিল ভাইয়ের নিঃস্বার্থ ভালোবাসা।
সালমান জানান, পরিবারে যখন টানাপোড়েন চরমে, তখন সালমানকে উৎসাহ দিয়ে বড় ভাই বলেছিলেন, ‘তুই শুধু পড়, প্রয়োজনে আমি রক্ত বিক্রি করেও তোর পড়ার খরচ চালাব।’ ভাইয়ের সেই কথা হয়ে ওঠে তার অনুপ্রেরণার উৎস।
সালমান দ্য ডেইলি ক্যাম্পাসকে বলেন, ‘বাবার সংগ্রাম, মায়ের দোয়া আর ভাইয়ের আত্মত্যাগ আমাকে এগিয়ে যেতে সাহস দিয়েছে। মাদ্রাসা থেকে এসেও যে কেউ দেশের সেরা বিশ্ববিদ্যালয়ে জায়গা করে নিতে পারে—আমি সেটাই প্রমাণ করতে চেয়েছি।’
এ বিষয়ে শ্রীবরদী সরকারি কলেজের রসায়ন বিভাগের সহকারী অধ্যাপক রিফাত আহমেদ বলেন, ‘যেসব শিক্ষার্থী আর্থিক দুরবস্থাকে পড়াশোনা না করতে পারার অজুহাত হিসেবে দাঁড় করাতে চায়, তাদের জন্য সালমান একজন দৃষ্টান্ত। তার পরিবারের আর্থিক অবস্থা সমাজের এক বাড়ে নিম্নস্তরের। একটি মলিন সাইকেলে করে প্রায় ১০ কিমি দূর থেকে প্রতিদিন আমার কাছে আসত পড়াশোনার আশায় আর মনিটরিং এর আশায়। সে ২০২৩ এর ফেব্রুয়ারিতে আমার তত্ত্বাবধানে আসে। আমি প্রথমেই জানতে চাই সারা দিনে কতক্ষণ পড়া হয় এভারেজে। সে ৪ থেকে ৫ ঘণ্টার কথা বলে। আমি বললাম যে আমার নির্দেশনা হচ্ছে প্রতিদিন ১২ ঘণ্টা বা কমপক্ষে ১০ ঘণ্টা পড়া আর নিয়মিত ধর্মীয় কাজ আদায় করা। জানতে চাইলাম যে সে পারবে কি না। সে বলল পারবে। এরপর থেকে প্রায় ১৮ মাস সে ধারাবাহিকভাবে আমার নির্দেশনা মেনেছে সালমান। ফলে এখন কোনো বিশ্ববিদ্যালয়েই তার চান্স আটকাচ্ছে না।’
পরামর্শ দিয়ে তিনি বলেন, ‘সব শিক্ষার্থীকে আমার একটাই পরামর্শ, যারা আর্থিকভাবে অসচ্ছল, তাদের সেটাকে অজুহাত হিসেবে দাঁড় করানোর সুযোগ নেই এবং সবারই এখান থেকে ধারাবাহিকতা ও আনুগত্যের যে অপরিসীম শক্তি, সে বিষয়ে শিক্ষা নিতে হবে; তবেই জীবনে সফলতা আসবে।’
সালমানের এই অসামান্য অর্জনে গর্বিত পুরো পিরিজপুর গ্রাম। এলাকাবাসী বলছেন, সালমান এখন শুধু একটি নাম নয়, একটি অনুপ্রেরণার প্রতীক, যার গল্প শুনে স্বপ্ন দেখতে শিখছে আমাদের আরও শত তরুণ।