Sunday, April 20, 2025

খালেদা-তারেকের সঙ্গে জামায়াত আমিরের সাক্ষাৎ কী বার্তা দিচ্ছে?

আরও পড়ুন

লন্ডনে চিকিৎসাধীন বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার সঙ্গে সম্প্রতি সাক্ষাৎ করেছেন জামায়াতে ইসলামীর আমির ডা. শফিকুর রহমান। তাদের এই সাক্ষাতে বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান ও জামায়াতের নায়েবে আমির সৈয়দ আবদুল্লাহ মোহাম্মদ তাহেরও উপস্থিত ছিলেন। তাদের সেই সাক্ষাৎ কী শুধু সৌজন্য ছিল, নাকি আগামী নির্বাচনকে সামনে রেখে দুই দলের নতুন কোনো মেরুকরণ হয়েছে; তা নিয়ে রাজনৈতিক মহলে বেশ আলোচনা রয়েছে। যদিও এ বিষয়ে উভয় পক্ষই চুপ থাকার নীতি গ্রহণ করেছে। দু’দলের নেতারা বলছেন, নির্বাচনের আগে হয়তো এ সাক্ষাতের ফল দৃশ্যমান হবে।

বিএনপির নেতাদের দাবি, এই সাক্ষাৎ নিয়ে ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান এখন পর্যন্ত দলের মধ্যে কোনো আলোচনা করেননি। তাছাড়া সেই সাক্ষাতে শুধু দলীয় চেয়ার‌পারসন খালেদা জিয়া ও তারেক রহমান ছিলেন। ফলে সাক্ষাতের বিষয়বস্তু তাদের দু’জনের বাইরে কারও জানা সম্ভব হয়নি। তবে, এটা কি শুধু সৌজন্য সাক্ষাৎ ছিল নাকি, তার কোনো রাজনৈতিক উদ্দেশ্য ও গুরুত্ব ছিল—সেটি আগামী কয়েকদিন মধ্যে হয়তো খোলাসা হবে।

বিএনপির স্থায়ী কমিটির একাধিক নেতা বলেন, ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগের বিদায়ের পর জামায়াত চেষ্টা করে যাচ্ছে বিএনপির প্রধান প্রতিপক্ষ হয়ে উঠতে। যার কারণে দলটির শীর্ষ নেতারা শুরু থেকে বিএনপিকে আক্রমণ করে কথা বলে আসছে। বিএনপিও ৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধে জামায়াতের ভূমিকা নিয়ে প্রশ্ন তুলছে। এছাড়া নানা বিষয়ে বিএনপিও জামায়াতের সমালোচনা করতে পিছু হটছে না। যার কারণে এক সময়ের মিত্র জামায়াতের সঙ্গে বিএনপির রাজনৈতিক সম্পর্ক খুবই একটু সুবিধার যাচ্ছে না। এই অবস্থায় খালেদা জিয়ার সঙ্গে জামায়াত আমিরের সাক্ষাতের রাজনৈতিক গুরুত্ব কিছুটা থাকতে পারে।

জামায়াতকে নিয়ে বিএনপির অতীত অভিজ্ঞতা ও দলের ভবিষ্যৎ রাজনীতিকে বিবেচনা নিলে দলটির সঙ্গে নতুন করে কোনো জোট কিংবা সমঝোতায় করার সিদ্ধান্ত হাইকমান্ড নেবে বলেও মনে করেন স্থায়ী কমিটির এই দুই নেতা।

বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য নজরুল ইসলাম খান ঢাকা পোস্টকে বলেন, “আমরা পত্র-পত্রিকার মাধ্যমে সাক্ষাতের বিষয়টি জেনেছি। ওই বৈঠকে তো আমরা ছিলাম না। সুতরাং কী আলোচনা হয়েছে, সেটাও আমাদের জানা নেই।”

আরও পড়ুনঃ  ঢাকাসহ ৯ অঞ্চলে ৬০ কি.মি. বেগে ঝড়ের পূর্বাভাস

বিএনপি আবারও জামায়াতের সঙ্গে জোটবদ্ধ হতে যাচ্ছে কিনা- জানতে চাইলে ২০ দলীয় জোটের সাবেক সমন্বয়ক নজরুল ইসলাম দলের ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা সম্পর্কে মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরের সঙ্গে কথা বলতে পরামর্শ দেন।

মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর ঢাকা পোস্টকে বলেন, “এটা একটা সৌজন্য সাক্ষাৎ। সৌজন্য সাক্ষাতের অংশ হিসেবে তারা ম্যাডামের (খালেদা জিয়া) সঙ্গে দেখা করতে গিয়েছেন।”

তিনি আরও বলেন, “জামায়াতের সঙ্গে আমরা তো অনেক দিন ধরে বিএনপি জোটে কাজ করেছি। তাদের সঙ্গে আমরা জোটবদ্ধ আন্দোলন করেছি। তারা লন্ডন সফরে গিয়েছিলেন, সেখানে গিয়ে তারা সৌজন্য সাক্ষাৎ করেছেন। নাথিং মোর দ্যান দ্যাট (এর বেশি কিছু নয়)।”

তবে, নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক বিএনপির স্থায়ী কমিটির আরেক সদস্য বলেন, “৫ আগস্টের পর সব জায়গায় বিএনপি খারাপ, বিএনপি চাঁদাবাজ, বিএনপি শুধু ক্ষমতায় চায়- এভাবে ‘উপস্থাপন’ করে আসছে জামায়াত। এক কথায় বলা যেতে পারে ৫ আগস্টের পর বিএনপির সবচেয়ে বেশি বিরোধিতা করে আসছে জামায়াত। সেই জামায়াতের সঙ্গে জোটবদ্ধ কিংবা আসন সমঝোতা করে বিএনপি আগামী নির্বাচনে অংশগ্রহণ করবে— এমন সিদ্ধান্ত দলের হাইকমান্ড নেবে বলে আমি ব্যক্তিগতভাবে মনে করি না।”

বিএনপির এই নেতা আরও বলেন, “জামায়াতকে নিয়ে বিগত ১৫ বছরের বেশি সময় ধরে বিএনপি বেশ বেকায়দায় ছিল। সেখান থেকে ২০২৪ সালের নির্বাচনের আগে ২০ দলীয় জোট ভেঙে দেওয়া হয়েছিল। যার পরিপ্রেক্ষিতে শেষ পর্যন্ত জামায়াতের সঙ্গ ত্যাগ করতে পেরেছে বিএনপি। আর এখন নতুন করে কিছু হওয়ার সম্ভাবনা খুবই কম।”

এই নেতা বলেন, এই সাক্ষাতের বিষয়টি যদি কোনো ব্যক্তি সামনে আনেন, তাহলে তিনি কোনো পক্ষপাতদুষ্ট ব্যক্তি এবং তার উদ্দেশ্য কী সেটা সবাই জানে। সুতরাং এ নিয়ে বেশি কিছু বলারও নেই।

বিএনপির সম্পাদকমণ্ডলীর এক নেতা বলেন, “ম্যাডাম খালেদা জিয়া পার্টির প্রধান এবং জামায়াতের আমিরও পার্টির প্রধান। দুই দলই দীর্ঘ সময় জোটগত রাজনীতি করেছেন, এখন জামায়াতের আমির যেহেতু লন্ডনে গেছেন, স্বাভাবিক সৌজন্যতার অংশ হিসেবে তিনি ম্যাডামের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেছেন। তবে, তাদের সাক্ষাতের বিষয়টি নিয়ে এখনও দলের মধ্যে সেইভাবে আলোচনা হয়নি। তবে রাজনীতিতে কখন কী হয় বলা যায় না।”

আরও পড়ুনঃ  আন্দোলনকারী নারীদের ওপর যৌন নিপীড়নও চালিয়েছে আ.লীগ

বিএনপির মিডিয়া সেলের অন্যতম সদস্য শায়রুল কবির খান ঢাকা পোস্টকে বলেন, খালেদা জিয়া অসুস্থ, লন্ডনে চিকিৎসাধীন আছেন। পত্রিকায় দেখেছি জামায়াতে ইসলামীর আমির লন্ডন সফরের সময় তার সঙ্গে সাক্ষাৎ করেছেন। এর বাইরে আর কিছু আমি বলতে পারব না।

জামায়াতের পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে, সাবেক জোট নেত্রী খালেদা জিয়া চিকিৎসার জন্য লন্ডনে যাওয়ার আগে তার সঙ্গে সাক্ষাতের সুযোগ হয়নি জামায়াতের। এখন দলের আমির সাংগঠনিক কাজে লন্ডন সফরে গেছেন। সেখানে আগে থেকেই চিকিৎসাধীন ছিলেন খালেদা জিয়া। সেখানে সাবেক রাজনৈতিক সহকর্মীর চিকিৎসার খোঁজ নেওয়াটা স্বাভাবিক ভদ্রতার বিষয়। এখানে কোনো রাজনৈতিক উদ্দেশ্য নেই।

এই বিষয়ে জামায়াতে ইসলামীর সেক্রেটারি জেনারেল মিয়া গোলাম পরওয়ার ঢাকা পোস্টকে বলেন, “বেগম জিয়া (খালেদা জিয়া) ৩ বারের প্রধানমন্ত্রী। দীর্ঘ ২২ বছর আমরা একসঙ্গে রাজনীতিতে সহযোগী এবং জোট নেত্রী হিসেবে ছিলেন। ফলে, আমাদের আমির নিজস্ব এবং সাংগঠনিক কাজে ইউরোপ সফরে গিয়েছিলেন। যেহেতু খালেদা জিয়া অসুস্থ এবং মজলুম, তিনি সেখানে চিকিৎসাধীন রয়েছেন। তাই একজন অসুস্থ সহকর্মীর শারীরিক খোঁজ-খবর নিতে গিয়েছিলেন। এখানে অন্য কোনো ব্যাপার কিংবা উদ্দেশ্য নেই।”

জোটবদ্ধ রাজনীতি হচ্ছে গণতান্ত্রিক রাজনীতির একটা রীতি বলে উল্লেখ করে জামায়াত নেতা গোলাম পরওয়ার বলেন, তবে, এখনই সবকিছু বলার পরিস্থিতি পরিপক্ব হয়নি। নির্বাচনী মেরুকরণ আরও অনেক হবে।

যারা ফ্যাসিবাদ বিরোধী আন্দোলনে ছিল, জুলাই মিত্র যারা— তাদের সঙ্গে জাতীয় ঐক্যের পরিবেশ সৃষ্টি হলে এবং নির্বাচনী যে কোনো ঐক্যে জামায়াতে ইসলামী থাকবে উল্লেখ করে তিনি বলেন, “এটা আমাদের নীতিগত সিদ্ধান্ত।”

কিন্তু কখন কার সঙ্গে কীভাবে হবে সেটা বোঝার জন্য আরও একটু সময় লাগবে বলে মনে করেন গোলাম পরওয়ার। জামায়াতের শীর্ষ এই নেতা বলেন, “তার জন্য নির্বাচনী পরিবেশ আরও ম্যাচিউর হতে হবে। এখনই আমরা কেন, কোনো দলই কিছু বলতে পারবে না।”

আরও পড়ুনঃ  ফ্যাসিস্ট আমলে বারবার শুনতাম খেলা হবে, সেই খেলা আর দেখতে চাই না

তবে দুপুরে রাজধানীর একটি হোটেলে সাম্প্রতিক সফর ও সাক্ষাতের প্রসঙ্গে জামায়াতের আমির ডা. শফিকুর রহমান বলেন, ‘জামায়াতে ইসলামীর মতো বিএনপিও জুলুমের শিকার হয়েছে। ব্যক্তি হিসেবে বিএনপির চেয়ারপারসন খালেদা জিয়াও জুলুমের শিকার। দেশ থেকে যাওয়ার আগে আমরা চিন্তা করেছিলাম (খালেদা জিয়ার সঙ্গে) একটা সাক্ষাৎ হবে। কিন্তু যেকোনো কারণেই হোক করতে পারিনি। ইউরোপ সফরে যাওয়ার পর আমার এক পরিবারের সদস্যের সঙ্গে দেখা করতে সেখানে (যুক্তরাজ্য) গিয়েছি। এরপর খালেদা জিয়ার সঙ্গে দেখা করেছি।’

সাক্ষাতের মূল উদ্দেশ্য তার (খালেদা জিয়া) খোঁজখবর নেওয়া ছিল বলে উল্লেখ করেন শফিকুর রহমান বলেন, তারা তাদের অতি সম্মান ও ভালোবাসার সঙ্গে গ্রহণ করেন। যেহেতু তিনি তার ছেলে ও দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যানের বাসায় অবস্থান করছেন, কাজেই তিনিও (তারেক রহমান) সেখানে থাকবেন, এটাই স্বাভাবিক। তিনিও ছিলেন।

জামাতের শীর্ষ নেতা বলেন, “দুই দলের দায়িত্বশীল ব্যক্তি এক জায়গায় বসলে সেখানে রাজনীতির কথা হবে না, এটা কি বাস্তব! বাস্তব নয়। কথা তো হয়েছে, কিন্তু সুনির্দিষ্ট বিষয় নিয়ে আলোচনা হয়নি। নির্বাচন কখন হবে, কীভাবে হবে, বিচারপ্রক্রিয়া কীভাবে হবে, না হবে—বিভিন্ন বিষয় নিয়ে সাধারণ আলোচনা হয়েছে।”

জামায়াতের ঢাকা মহানগরের একজন নেতা বলেন, “খালেদা জিয়া লন্ডনে যাওয়ার আগে তো তার সঙ্গে আমাদের আমিরের সাক্ষাতের সুযোগ হয়নি। এখন তিনি যখন লন্ডনে গিয়েছেন তখন সাক্ষাৎ একটা সুযোগ নিয়েছেন। এছাড়া তিনি (খালেদা জিয়া) দীর্ঘদিন জোট নেত্রী ছিলেন। বাংলাদেশে রাজনীতিতে তিনি এখন জননন্দিত নেতা।”

জামায়াতের এই নেতা আরও বলেন, “এই সাক্ষাতের রাজনৈতিক একটা গুরুত্ব তো অবশ্যই আছে। এখন দেশের সবচেয়ে বড় দুই দল হচ্ছে বিএনপি এবং জামায়াত।

আপনার মতামত লিখুনঃ

সর্বশেষ সংবাদ