ভারত মরিয়া হয়ে গেছে ড. ইউনূসকে উৎখাতের জন্য। তারা তো জুলাই বিপ্লব থেকে উদ্ভূত সরকারকে মানতেই চাচ্ছিল না। বিগত ৮ মাস ধরে ড. ইউনূসের ইন্টারিম সরকারকে ডিস্ট্যাবিলাইজ করার জন্য তারা অসংখ্য প্রচেষ্টা চালিয়েছে। ভারতের লোকাল এজেন্ট আওয়ামী লীগের কর্মী বা সমর্থক, যারা দেশের মধ্যে ঘাপটি মেরে বসে আছে, তারা ছোটখাটো আন্দোলনে অনুপ্রবেশ করে আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি ঘটানোর চেষ্টা করেছে। কিন্তু তাদের সব প্রচেষ্টাই ব্যর্থ হয়েছে।
ভারতে পশ্চিমবঙ্গ বিজেপি এবং ভারতের প্রায় সবকটি গণমাধ্যমে সাম্প্রতিক অতীতে এমনও হুমকি দেওয়া হয়েছে যে, বাংলাদেশে তাদের কল্পিত হিন্দু নির্যাতন বন্ধ না করলে, তারা বাংলাদেশের ফেনী কেটে দিয়ে ভারতের সঙ্গে যুক্ত করবে। ফলে ফেনী, চট্টগ্রাম এবং তিন পার্বত্য জেলা বাংলাদেশ থেকে বিচ্ছিন্ন হবে। এসব হুমকিও বাংলাদেশের জনগণ এবং তাদের ইন্টারিম সরকারকে এতটুকু বিচলিত করতে পারেনি।
কথায় বলে, হাতি ঘোড়া গেল তল, ভেড়া বলে কত জল। এখন তারা ব্যারিস্টার তানিয়া আমিরের ঘাড়ে সওয়ার হয়েছে। আওয়ামী লীগার ব্যারিস্টার আমিরুল ইসলামের কন্যা আরেক পাঁড় আওয়ামী লীগার এ তানিয়া আমির বাংলাদেশে জরুরি অবস্থা জারির ওকালতি করেছেন। শুধু তাই নয়, জরুরি অবস্থা জারিতে সেনাবাহিনী নাকি দৃঢ় সমর্থন দেবে বলেও তিনি আশাবাদী। ‘ইন্ডিয়া টুডে’ নামক ভারতের বহুল প্রচারিত গণমাধ্যমে তিনি বলেন, ‘রাষ্ট্রপতি সাহাবুদ্দীন সংবিধানের ১৪১ অনুচ্ছেদ ব্যবহার করে জরুরি অবস্থা জারি করতে পারেন; আর এ ক্ষেত্রে সেনাপ্রধান ওয়াকার-উজ-জামান তাকে দৃঢ়ভাবে সমর্থন করতে পারেন।
ফলে রাষ্ট্রপতি অন্তর্বর্তী সরকার বাতিল করে দ্রুত ও অন্তর্ভুক্তিমূলক নির্বাচনের আয়োজন করতে পারবেন। সেনাবাহিনী সন্ত্রাসী ও অপরাধীদের কঠোর হস্তে দমন করতে পারবে এবং সুষ্ঠু নির্বাচনের জন্য সঠিক পরিবেশ সৃষ্টি করতে পারবে’। ইন্ডিয়া টুডে এরপর বলছে, ‘তবে তানিয়া আমিরের এমন মন্তব্য উড়িয়ে দিয়েছেন সেনাকর্মকর্তারা’। কিন্তু মানুষের বক্তব্য হলো, তানিয়া আমির যদি বাংলাদেশে অবস্থান করে প্রকাশ্যে এ ধরনের উসকানি দিতে থাকে, তাহলে তাকে গ্রেফতার করা হচ্ছে না কেন?
যে ভারত বারবার বাংলাদেশকে অস্থিতিশীল করার জন্য সেনাবাহিনীকে উসকানি দিয়েছে, সেই সেনাপ্রধান জেনারেল ওয়াকার-উজ-জামান গত ১৩ এপ্রিল বৌদ্ধ সম্প্রদায়ের সম্প্রীতি ভবনের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন অনুষ্ঠানে প্রধান উপদেষ্টা ড. ইউনূসের ভূয়সী প্রশংসা করেছেন। তিনি বলেছেন, প্রধান উপদেষ্টা ড. ইউনূস এ সম্প্রীতি ভবন নির্মাণে তাকে (সেনাপ্রধানকে) অনুপ্রাণিত করেছেন। এজন্য সেনাপ্রধান বলেন, তিনি ড. ইউনূসের প্রতি কৃতজ্ঞ।
ভারত যখন বুঝল, কোনোভাবেই ইন্টারিম সরকারকে হটানো যাবে না, তখন তারা অর্থনৈতিক অস্ত্র প্রয়োগ করল। তারা নেপাল ও ভুটান ছাড়া পৃথিবীর অন্যসব দেশে বাংলাদেশের ট্রান্সশিপমেন্ট সুবিধা একতরফাভাবে বাতিল করে। ড. ইউনূস এবারও এতটুকু বিচলিত না হয়ে সিলেট বিমানবন্দর দিয়ে অধিক পরিমাণে কার্গো বিমান চলাচলের নির্দেশ দেন। একইসঙ্গে তিনি হযরত শাহজালাল বিমানবন্দরের থার্ড টার্মিনালের উদ্বোধন এ বছরের মধ্যেই সম্পন্ন করার নির্দেশ দেন। ভারত বুঝতে পারছে, ইন্টারিম সরকার এবং ড. ইউনূসকে কোনো অবস্থাতেই নত করা সম্ভব নয়। সেজন্য তারা মনে করেছে, নির্বাচন ছাড়া ড. ইউনূসকে সরানো সম্ভব নয়। তাই তারা বাংলাদেশের নির্বাচন দ্রুত অনুষ্ঠান করার জন্য উঁচু গলায় কথা বলছে।
বাংলাদেশে কবে নির্বাচন হবে, কীভাবে নির্বাচন হবে, সেটি একান্তই বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ ব্যাপার। কিন্তু এ ব্যাপারে ভারত কথা বলার কে? সাধারণভাবে ভারতের এবং বিশেষভাবে পশ্চিমবঙ্গের কথাবার্তা দেখে মনে হচ্ছে, বাংলাদেশে নির্বাচনটাই যেন তাদের অর্থাৎ ভারতের একমাত্র এজেন্ডা। বাংলাদেশের নির্বাচন নিয়ে কথা বলেছেন তাদের সরকারের দ্বিতীয় প্রধান ক্ষমতাশালী ব্যক্তি স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ। কথা বলেছেন পররাষ্ট্রমন্ত্রী এস জয়শংকর। কথা বলেছেন ভারতীয় সেনাবাহিনীর প্রধান জেনারেল উপেন্দ্র নাথ ত্রিবেদি। আরও কথা বলেছেন ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র রণধীর জয়সওয়াল। এর আগে কথা বলেছেন তাদের পররাষ্ট্র সচিব বিক্রম মিশ্রি।
বাংলাদেশের সেনাপ্রধান জেনারেল ওয়াকার-উজ-জামান বলেছিলেন, সরকার সর্বোচ্চ ১৮ মাসের মধ্যে নির্বাচন দেবে। বিদেশি একাধিক দৈনিক পত্রিকা এবং নিউজ এজেন্সির কাছে প্রদত্ত সাক্ষাৎকারে ড. ইউনূসও একই রকম কথা বলেছেন। অর্থাৎ ১৮ মাসের মধ্যেই নির্বাচন হবে। ওইভাবে হিসাব করে তখন অনেকে ধারণা করেছিলেন যে এ ১৮ মাস শেষ হবে আগামী বছরের জুনে।
২.আমাদের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে ভারত নাক গলানো নয়, রীতিমতো সরাসরি হস্তক্ষেপ করছে কেন? ‘রাইজিং ভারত’ নামক একটি ভারতীয় গণমাধ্যমে ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী এস জয়শংকর বলেছেন, বাংলাদেশ নিয়ে ভারতের অনেক উদ্বেগ রয়েছে। এর মধ্যে ৩টি হলো, ভারতের বিরুদ্ধে বাংলাদেশের রেটোরিক (এখানে রেটোরিক বলতে তিনি বিষোদ্গার বুঝিয়েছেন)। অপরটি হলো র্যাডিক্যালিজম (এখানে র্যাডিক্যালিজম বলতে ইসলামি চরমপন্থা বুঝিয়েছেন)।
আর তৃতীয়টি হলো মাইনরিটি পার্সিকিউশন, অর্থাৎ সংখ্যালঘুদের ওপর অত্যাচার। জয়শংকর আরও বলেন, গণতন্ত্রের মূলকথা হলো নির্বাচন। নির্বাচনের মাধ্যমেই জনগণের রায় নেওয়া হয় বা রায় রিনিউ করা হয় (রিনিউ শব্দটি জয়শংকরের ভাষা)। তাই ভারতীয় পররাষ্ট্রমন্ত্রীর বক্তব্য, বাংলাদেশ সরকার যত দ্রুত সম্ভব নির্বাচন দিক। এর আগে তাদের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র রণধীর জয়সওয়াল বলেছেন, বাংলাদেশ গণতন্ত্রে উত্তরণের জন্য একটি অন্তর্ভুক্তিমূলক নির্বাচন দিক। বলাবাহুল্য, অন্তর্ভুক্তিমূলক নির্বাচন বলতে তারা সব রাজনৈতিক দল অর্থাৎ আওয়ামী লীগের অংশগ্রহণকেই বুঝিয়েছেন।
এর কিছুদিন আগে ভারতের সেনাপ্রধান জেনারেল ত্রিবেদি যা বলেছেন, সেটি আরও মারাত্মক। তিনি বলেন, ভারতের আর্মির সঙ্গে বাংলাদেশের আর্মির যোগাযোগে কোনো সমস্যা নেই। কিন্তু সরকারের সঙ্গে ভারতের স্বাভাবিক সম্পর্ক গড়তে গেলে নির্বাচিত সরকারের সঙ্গে গড়তে হবে। অন্যকথায়, তারা ড. ইউনূসের সরকারকে স্বীকৃতি দিতে চাননি। সেজন্যই গত সেপ্টেম্বরে নিউইয়র্কে ড. ইউনূসের সঙ্গে নরেন্দ্র মোদি দেখা করেননি। থাইল্যান্ডে সদ্যসমাপ্ত বিমসটেকের মিটিংয়ের সাইডলাইনেও তিনি ড. ইউনূসের সঙ্গে দেখা করতে চাননি। চীনের প্রেসিডেন্টের সঙ্গে বৈঠকের সময় ড. ইউনূস বলেছিলেন, ভারতের সেভেন সিস্টার্স ল্যান্ডলক্ড অর্থাৎ স্থলবেষ্টিত। এসব রাজ্যের সমুদ্রে প্রবেশের পথ হলো বাংলাদেশ। বাংলাদেশ এ জলপথের প্রধান অভিভাবক।
এ মন্তব্যের কারণেই নরেন্দ্র মোদি ড. ইউনূসের সঙ্গে বৈঠক করেছেন। ড. ইউনূসের এ দুটি মন্তব্যে ভারত দারুণ চটেছে। কিন্তু এতে গোস্সা করার কি আছে? সেভেন সিস্টার্স তো স্থলবেষ্টিত। আসলে ভারতের মাথাব্যথা অন্যত্র। প্রেসিডেন্ট শি জিন পিংয়ের সঙ্গে বৈঠকের সময় ড. ইউনূস তার ভিশন তুলে ধরেছেন।
বলেছেন, নেপাল, ভুটান, বাংলাদেশ, আরাকান এবং সেভেন সিস্টার্স নিয়ে একটি অর্থনৈতিক অঞ্চল গড়ে তুলতে হবে। এক্ষেত্রে শিল্পায়নে চীনের বিপুল অভিজ্ঞতা কাজে লাগালে, চীন যেমন এ অঞ্চলে তার পণ্য রপ্তানি করতে পারবে তেমনি এ অঞ্চলভুক্ত ৪টি দেশ এবং সেভেন সিস্টার্সও চীনে নিজেদের পণ্য রপ্তানি করতে পারবে। তা ছাড়া এ ৪টি দেশ এবং সেভেন সিস্টার্স নিজেদের পণ্য নিজেদের মধ্যে আদান-প্রদান করতে পারবে। ড. ইউনূসের এ ভিশনই ভারতের গায়ে জ্বালা ধরিয়েছে। তাই তারা আদা পানি খেয়ে ড. ইউনূসের সঙ্গে শত্রুতায় লিপ্ত হয়েছে।
ভারত যত ড. ইউনূসের শত্রুতা করছে, ততই ড. ইউনূস বাংলাদেশের জনগণের কাছে বেশি করে পপুলার হচ্ছেন। এখন ভারত বুঝতে পারছে নির্বাচন ছাড়া ড. ইউনূসকে ক্ষমতা থেকে সরিয়ে দেওয়া সম্ভব নয়। তাই তারাও অবাঞ্ছিতভাবে বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ ব্যাপারে (দ্রুত নির্বাচন অনুষ্ঠান করা) প্রকাশ্যে হস্তক্ষেপ করছে।
৩.ভারতের প্রধানমন্ত্রী, পররাষ্ট্রমন্ত্রী এবং পররাষ্ট্র সচিব বলেছেন, ভারত পিপল টু পিপল অর্থাৎ ভারতের জনগণের সঙ্গে বাংলাদেশের জনগণের সম্পর্ক রচনা করবে। এমন মধুর বাক্য বর্ষণের জন্য তাদের মুখে ফুলচন্দন দিতে চেয়েছিলাম। কিন্তু দেখা যাচ্ছে, ওদের কথায় এবং কাজে কোনো মিল নেই। বাংলাদেশের কোটি কোটি মানুষ ছাত্রনেতাদের নেতৃত্বে শেখ হাসিনাকে তাড়িয়েছে। পৃথিবীর কোনো দেশ হাসিনাকে গ্রহণ করতে রাজি হয়নি। অগত্যা মধুসূদন! শেখ হাসিনা ভারত থেকে এসেছিলেন। আবার ভারতেই ফিরে গেলেন।
তবে ড. ইউনূস বলেছিলেন, শেখ হাসিনা সেখানে থাকতে পারেন, তবে তাকে চুপ থাকতে হবে। কিন্তু ভারত সে কথায় কর্ণপাত করেনি। শেখ হাসিনা দুই চার দিন পরপরই তার অডিও মেসেজ ইউটিউবে আপলোড করছেন। সর্বশেষ মেসেজে সোজাসাপটা আওয়ামী লীগ কর্মীদের নির্দেশ দিয়েছেন, তারা যেন এবার পালটা আঘাত করে। আওয়ামী লীগ কর্মীর ওপর হামলা হলে তারাও যেন পালটা আঘাত করে। এটাই কি পিপল টু পিপল কন্টাক্টের নমুনা?
ভারত বাংলাদেশের কাছে সবসময় দাবি করে, ভারতবিরোধী কর্মকাণ্ডে বাংলাদেশের মাটি যেন ব্যবহৃত না হয়। কিন্তু এখন যে ভারতের মাটি প্রকাশ্যে বাংলাদেশবিরোধী কর্মকাণ্ডে ব্যবহৃত হচ্ছে, তার বেলায়? গণমাধ্যমে খবর এসেছে, ভারতে এখন ১ লাখ আওয়ামী কর্মী এবং সমর্থক অবস্থান করছে। এদের অধিকাংশ পশ্চিমবঙ্গে অবস্থান নিয়েছে। বাকিরা ত্রিপুরা, আসাম এবং দিল্লিতে আস্তানা গেড়েছে। কেন এদের শেল্টার দেওয়া হচ্ছে? শেখ হাসিনা ক্যাপ্টেন মাজেদকে ফেরত চেয়েছিলেন। ভারত ফেরত দিয়েছে এবং ক্যাপ্টেন মাজেদকে শেখ হাসিনা ফাঁসি দিয়েছেন। তাহলে আইনানুগ বিচারের জন্য শেখ হাসিনাসহ বাংলাদেশের পলাতক সাবেক মন্ত্রী এবং এমপিদের ভারত ফেরত দেবে না কেন?
ভারত যখন-তখন বাংলাদেশের হিন্দুদের ওপর নির্যাতনের কথা বলে। এখন বাংলাদেশকেও দাবি করতে হবে, ভারত যেন সে দেশের ২০ কোটি মুসলমানের ওপর আর নির্যাতন না করে। মুসলমানদের ওপর ভারতের নির্যাতনের কাহিনি বলতে গেলে একটি মহাকাব্য রচনা করতে হবে। বাংলাদেশে হিন্দুদের ওপর কোনো নির্যাতন হচ্ছে না।
কিন্তু ভারতে মুসলমানদের ওপর নির্যাতনের ধারাবাহিকতায় সর্বশেষ সংযোজন হলো ওয়াক্ফ আইন বাতিল। ভারতের সমগ্র মুসলিমসমাজ সেখানে অনেকটা দ্বিতীয় শ্রেণির নাগরিকের মতো বসবাস করছেন। এ ব্যাপারে প্রয়োজন হলে বাংলাদেশ থেকেও বজ্রনির্ঘোষ আওয়াজ তুলতে হবে, আর যেন মুসলমানরা হিন্দুত্ববাদী নিপীড়নের শিকার না হয়।